রোজা অবস্থায় রক্তদান করা নিয়ে: ইসলামি ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
১. ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোণঃ ইসলামের দৃষ্টিতে রোজার দুটি মূল শর্ত আছে:
ক) কিছু খাওয়া বা পান করা যাবে না। খ) কোনো কিছু গ্রহণ করা যাবে না যা শরীরে পুষ্টি বা শক্তি সরবরাহ করে
(ক) রক্তদান কি রোজা ভঙ্গ করে? – শরিয়া মতে, রক্তদানের মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের হয়, যা খাবার বা পানীয়ের মতো শরীরের ভেতরে কিছু প্রবেশ করানোর মতো নয়। তাই অধিকাংশ ইসলামি স্কলারদের মতে, এটি রোজা ভঙ্গ করে না। তবে কিছু ইসলামি পণ্ডিতের মতে, যদি রক্তদানের ফলে শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে রোজা রাখা কঠিন হয়ে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে ফেলা বৈধ হতে পারে।
(খ) রক্ত নেওয়া কি রোজা ভঙ্গ করে? – রক্ত নেওয়া (Blood Transfusion) অর্থাৎ শরীরে রক্ত প্রবেশ করানো হলে এটি রোজা ভঙ্গ করবে, কারণ এটি শরীরে পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে। তাই কেউ যদি রোজা রেখে রক্ত গ্রহণ করে, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে এবং পরবর্তীতে কাজা করতে হবে।
(গ) রাসূল (সা.) ও সাহাবাদের আমলঃ – ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবারা রোজা রেখে হিজামা (cupping therapy বা শরীর থেকে রক্ত বের করা) করতেন। একাধিক হাদিসে এই প্রসঙ্গ পাওয়া যায়, যা বোঝায় যে রক্ত বের করা রোজা ভঙ্গ করে না।
হাদিস থেকে দলিল
১. ইবন আব্বাস (রা.) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজা অবস্থায় হিজামা (শিঙ্গা লাগানো) করেছেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯৩৮)
২. আবু সাইদ আল-খুদরি (রা.) বলেনঃ “রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা অবস্থায় এমন কিছু করো না যা তোমাদের দুর্বল করে দেয়।'” (আবু দাউদ, হাদিস: ২৩৬৭)
(ঘ) সিদ্ধান্তঃ – রক্তদান করা শরিয়তসম্মত এবং এটি রোজা ভঙ্গ করে না। তবে যদি এটি রোজাদারের জন্য অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণ হয়, তাহলে ইফতারের পর রক্তদান করা উত্তম। রক্ত নেওয়া সময় (Blood Transfusion) করলে রোজা ভেঙে যাবে।
২. চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণঃ – রক্তদান করার সময় শরীর থেকে ৪৫০-৫০০ মিলিলিটার রক্ত বের হয়, যা সুস্থ মানুষের জন্য সাধারণত কোনো ক্ষতির কারণ হয় না। তবে রোজা অবস্থায় এটি কিছু প্রভাব ফেলতে পারে।
(ক) রক্তদানের সম্ভাব্য শারীরিক প্রভাবঃ – রক্তচাপ কমে যেতে পারে, ফলে মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে। ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কারণ রোজা অবস্থায় পানি পান করা যায় না। হিমোগ্লোবিনের সাময়িক ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি আসতে পারে কম রক্তচাপ বা রক্তস্বল্পতা থাকলে সমস্যা হতে পারে, তাই আগে থেকেই সুস্থ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
(খ) কখন রক্তদান করা নিরাপদ? – ইফতারের পর রক্তদান করাই ভালো, কারণ তখন শরীরে পানি ও খাবার প্রবেশ করতে পারে এবং দুর্বলতা দূর হয়। সাহরিতে পর্যাপ্ত পানি ও লবণযুক্ত খাবার খেলে শরীর ভালো থাকবে। যদি রক্তদানের ফলে খুব দুর্বল লাগে, তাহলে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। যাদের রক্তস্বল্পতা (anemia) বা দুর্বলতা আছে, তারা রোজা রেখে রক্তদান না করাই ভালো।
৩. সর্বোত্তম করণীয়ঃ – যদি কেউ অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে রোজা রেখে রক্তদান করতে বাধ্য হয়, তাহলে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবেঃ ✔ রক্তদানের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া উচিত। ✔ অতিরিক্ত দুর্বলতা অনুভব করলে রোজা ভাঙা জায়েজ, তবে পরে কাজা করতে হবে। ✔ যদি সম্ভব হয়, ইফতারের পর রক্তদান করাই উত্তম। ✔ রক্তদানের আগে ও পরে পর্যাপ্ত পানি ও খাবার গ্রহণ করা উচিত (ইফতার ও সাহরিতে)।
✅ ইসলামি বিধানঃ – রক্তদান রোজা ভঙ্গ করে না, তবে দুর্বল হলে ইফতারের পর করা ভালো। তবে রক্ত নেওয়া সময় (Blood Transfusion) করলে রোজা ভেঙে যাবে।
✅ চিকিৎসা দৃষ্টিকোণঃ – রক্তদান করলে সাময়িক দুর্বলতা আসতে পারে। সাহরি ও ইফতারের সময় পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। ইফতারের পর রক্তদান করাই সবচেয়ে ভালো ও নিরাপদ পদ্ধতি।
যদি জরুরি প্রয়োজন হয়, তবে রোজা রেখেও রক্তদান করা যায়, তবে শরীরের অবস্থার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর যদি কোনো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে ইফতারের পর রক্তদান করাই উত্তম।