আপনি কি রক্তদানের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন | APF Blood Donation
Riduwan Hossain -
প্রিন্ট সংস্করণ -
আপডেট -
৭ মার্চ, ২০২৫ ১১:০২
![]()
রক্তদানের ইতিহাস: প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এক বিস্তৃত বিশ্লেষণ
রক্তদান এবং রক্ত সঞ্চালন বিজ্ঞানের এক অনন্য আবিষ্কার, যা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এই আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা গবেষণা, ব্যর্থতা ও সাফল্যের এক দীর্ঘ ইতিহাস। আজ আমরা রক্তদান ও রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস বিশদভাবে পর্যালোচনা করব, যেখানে থাকবে এর আবিষ্কারের ধাপ, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ এবং বর্তমান যুগের উন্নয়ন।
প্রাচীনকাল: রক্তের রহস্য ও কুসংস্কার (খ্রিস্টপূর্ব যুগ – ১৫শ শতক)
রক্তের প্রতি প্রাচীন বিশ্বাস
প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে রক্তকে রহস্যময় ও শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে রক্তকে জীবনশক্তির বাহক বলে মনে করা হতো, যা অসুস্থতাকে দূর করতে পারে।
- প্রাচীন মিশর: চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন যে, রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত হয় এবং এটি শারীরিক শক্তির মূল উপাদান।
- গ্রীস ও রোম: গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস (Hippocrates, ৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব) “চারটি প্রধান দেহরস” (Blood, Phlegm, Yellow Bile, Black Bile) তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই উপাদানগুলোর ভারসাম্যহীনতা অসুস্থতার কারণ।
- রোমান সাম্রাজ্য: রোমানরা বিশ্বাস করতেন যে গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তে শক্তি ও সাহস আছে, তাই অনেকে তা পান করতেন।
মধ্যযুগ: রক্তপাত (Bloodletting) ও ব্যর্থ চিকিৎসা
এই সময়ে রক্তপাত (Bloodletting) চিকিৎসার জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে ওঠে। চিকিৎসকরা মনে করতেন, অতিরিক্ত রক্ত বের করে দিলে শরীর সুস্থ হয়ে উঠবে।
- মধ্যযুগের চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরণের উপায়ে রক্তপাত করতেন, যেমন:
- শিঙ্গা (Leech) ব্যবহার করে রক্ত শোষণ
- ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে রক্ত বের করা
- ১৪৯২ সালে পোপ ইনোসেন্ট VIII-এর জীবন বাঁচানোর জন্য তিনজন কিশোরের রক্ত সঞ্চালনের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তারা সবাই মারা যান।
এগুলো প্রমাণ করে যে, তখন রক্তদান ও রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা ছিল না।
রক্ত সঞ্চালনের শুরুর যুগ (১৬শ – ১৭শ শতক)
১৬শ ও ১৭শ শতকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি রক্তচিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
প্রথম সফল গবেষণা ও পরীক্ষাগুলো
- ১৬২৮ সালে ইংরেজ চিকিৎসক উইলিয়াম হার্ভে (William Harvey) তার বিখ্যাত গ্রন্থ “De Motu Cordis” এ প্রথমবারের মতো রক্ত সঞ্চালনের সঠিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন।
- ১৬৬৫ সালে ইংরেজ চিকিৎসক রিচার্ড লোয়ার (Richard Lower) প্রথমবারের মতো কুকুরের মধ্যে সফল রক্ত সঞ্চালন করেন।
- ১৬৬৭ সালে ফরাসি চিকিৎসক জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট ডেনিস (Jean-Baptiste Denis) এক রোগীর শরীরে ভেড়ার রক্ত সঞ্চালন করেন। এই পরীক্ষার ফলে রোগী মারা যান, এবং ইউরোপে রক্ত সঞ্চালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
আধুনিক রক্ত সঞ্চালনের সূচনা (১৮শ – ১৯শ শতক)
মানব থেকে মানব রক্ত সঞ্চালনের প্রথম সাফল্য
- ১৮১৮ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জেমস ব্লান্ডেল (James Blundell) প্রথমবারের মতো একজন মানুষের রক্ত আরেকজনের শরীরে সঞ্চালন করেন।
- ১৮৭৪ সালে বিজ্ঞানীরা সোডিয়াম ফসফেট ব্যবহার করে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
এই আবিষ্কারগুলো আধুনিক রক্ত সঞ্চালনের ভিত্তি গড়ে তোলে।
রক্তের গ্রুপের আবিষ্কার ও আধুনিক রক্তদান (২০শ শতক – বর্তমান)
রক্তের গ্রুপ ও Rh ফ্যাক্টরের আবিষ্কার
- ১৯০১ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার (Karl Landsteiner) রক্তের গ্রুপ A, B, ও O আবিষ্কার করেন, যা রক্তদানের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
- ১৯৪০ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার ও আলেকজান্ডার উইনার (Alexander Wiener) Rh ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন, যা রক্তগ্রহণকারীর সঙ্গে মিলানোর জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
রক্তদান ব্যবস্থার উন্নতি
- ১৯৩৭ সালে শিকাগোতে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৯৫০-এর দশকে রক্তের সংক্রমণ রোধে কঠোর পরীক্ষা শুরু হয়।
- ১৯৮০-এর দশকে এইচআইভি ও হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বাধ্যতামূলক রক্তপরীক্ষা চালু হয়।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের রক্তদান ব্যবস্থা
আধুনিক রক্তদানের বৈশিষ্ট্য
- স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
- উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষিত রক্ত দীর্ঘদিন ব্যবহার করা সম্ভব।
- কৃত্রিম রক্তের গবেষণা চলছে, যা ভবিষ্যতে রক্তের সংকট কমাতে পারে।
উন্নত চিকিৎসায় রক্তের ভূমিকা
- ক্যানসার, দুর্ঘটনা ও অস্ত্রোপচারের রোগীদের জন্য রক্তদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- উন্নত প্লাজমা থেরাপি ও স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে রক্তদানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে।
রক্তদান আজ শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফল নয়, এটি মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অতীতের ব্যর্থতা ও ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞানীরা রক্তদানকে নিরাপদ ও কার্যকর করেছেন। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়তো কৃত্রিম রক্ত আবিষ্কার করা সম্ভব হবে, যা বিশ্বব্যাপী রক্তের সংকট কমাতে সাহায্য করবে।
তথ্যসূত্র
- William Harvey’s “De Motu Cordis” (1628) – রক্তপ্রবাহ ব্যাখ্যা।
- James Blundell’s Research (1818) – মানব-মানব রক্ত সঞ্চালন।
- Karl Landsteiner’s Nobel Prize-winning work (1930) – রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার।
- World Health Organization (WHO) Reports – আধুনিক রক্তদান তথ্য।